
নাজমুল হাসান,মাদারীপুর প্রতিনিধিঃ
মাদারীপুরে অবৈধ বালুর ব্যবসা ও হাটবাজার ইজারাকে কেন্দ্র করে স্থানীয় আ.লীগের ২গ্রুপের মধ্যে রক্তক্ষয়ী এক সংঘর্ষ হয়,এতে তিন জনকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।

৮ই মার্চ (শনিবার) মাদারীপুর সদর উপজেলার খোয়াজপুর ইউনিয়নে ঘটে লোহমর্ষক এই ঘটনা।
এদিকে আলোচিত এই হত্যার ঘটনায় ৪৯ জনকে এজাহারভুক্ত ও ৮০ থেকে ৯০ জনকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়।৯ই মার্চ(রোববার) ভোরে সদর মডেল থানায় নিহত সাইফুল ও আতাউর সরদারের মা সুফিয়া বেগম বাদী হয়ে এ হত্যা মামলাটি দায়ের করেন।
এ ঘটনায় পুলিশ দুজনসহ এক নারীকে গ্রেপ্তার দেখিয়েছে। তারা হলেন- সদর উপজেলার খোয়াজপুর টেকেরহাট এলাকার মতিউর রহমান সরদারের স্ত্রী কুলসুম বেগম (৫২), একই এলাকার মৃত পানু ব্যাপারীর ছেলে সুজন মাহমুদ (২৮) ও মো. গনি ব্যাপারীর ছেলে মো. রুবেল ব্যাপারী (৩২)। আসামিদের রোববার দুপুরে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
নিহত ওই তিন ভাই হলেন- আতাউর রহমান সরদার ওরফে আতাবুর (৩৫) ও সাইফুল ইসলাম ওরফে হিটার সাইফুল (৩০), তাদের চাচাতো ভাই পলাশ সরদার (১৭)। আতাউল ও সাইফুল সদর উপজেলার খোয়াজপুর ইউনিয়নের সরদার বাড়ি এলাকার আজিবর সরদারের ছেলে ও পলাশ একই এলাকার মুজাম সরদারের ছেলে। নিহত সাইফুল খোয়াজপুর ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন।
জানা গেছে, প্রকাশ্যে পিটিয়ে দুই পা ভেঙে দেওয়ার প্রতিশোধ ও হাট-বাজার ইজারার দখল নেওয়ার জন্য স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা সাইফুল ইসলাম সরদারসহ তিনজনকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। মাদারীপুর সদর উপজেলার খোয়াজপুর এলাকার বালু ব্যবসায়ী হোসেন সরদার (৬০) ও তার লোকজনের বিরুদ্ধে হত্যাকাণ্ড ঘটানোর অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনায় শনিবার (৮ মার্চ) রাতে মাদারীপুর সদর থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেছেন নিহত সাইফুলের মা সুফিয়া বেগম।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, মাদারীপুর জেলা আওয়ামী লীগ অধ্যুষিত এলাকা হওয়ায় দুই ভাগে বিভক্ত ছিল জেলা আওয়ামী। এক পক্ষের নেতৃত্ব দিতেন সাবেক নৌ-পরিবহন মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শাজাহান খান এবং অপর পক্ষের নেতৃত্ব দিতেন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দীন নাসিম। নিহত সাইফুল বাহাউদ্দীন নাসিম সমর্থিত খোয়াজপুর ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। আর তার প্রতিপক্ষ অভিযুক্ত হোসেন সরদার (৬০) ছিলেন শাজাহান খান সমর্থিত আওয়ামী লীগ নেতা। আওয়ামীলীগ ক্ষমতা থাকাকালীন সময়ে নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের সিন্ডিকেট ও খোয়াজপুর-টেকেরহাট বাজারের ইজারা দখল নিয়ে তাদের মধ্যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়।
নিহত সাইফুল আওয়ামী লীগের বাহাউদ্দিন নাসিমের রাজনীতি করতেন।
এ দ্বন্দ্বের জেরে ২০২৪ সালের ২ ফেব্রুয়ারি দুপুরে খোয়াজপুর বাজারের মধ্যে প্রকাশ্যে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে হোসেন সরদারের দুই পা ভেঙে দেন সাইফুল ইসলাম সরদার ও তার লোকজন। তারা সম্পর্কে চাচা-ভাতিজা। ৫ই আগষ্টে আওয়ামীলীগ সরকারের পতনের পর রদবদল করে স্থানীয় বিএনপি নেতা শাজাহান খান ওরফে শাজাহান মোহরীর সঙ্গে যোগ দেন হোসেন সরদার।
পরে পা ভাঙ্গার প্রতিশোধ ও পুরো সিন্ডিকেট দখলে নিতে মরিয়া হয়ে ওঠেন তিনি। এ নিয়ে মাসখানেক আগে দুই গ্রুপের মধ্যে হামলা ভাংচুরেরও ঘটনা ঘটে। একপর্যায়ে শনিবার (৮ মার্চ) হামলা চালিয়ে সাইফুল ও তার ভাই আতাবুর ইসলাম সরদারকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে হোসেন সরদারের লোকজন। একই সঙ্গে কুপিয়ে গুরুতর আহত করা হয় নিহত সাইফুলের আরেক ভাই অলিল সরদার ও চাচাতো ভাই পলাশ সরদারসহ আরও ৮ জনকে। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেলে প্রেরণ করলে সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় পলাশের মৃত্যু হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে নিহত সাইফুলের এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয় জানান, এক সময় এলাকায় খুব প্রভাব ছিল সাইফুলের। বিভিন্ন বিচার শালিসিও করতেন তিনি। মানুষ তার কথা মানতো। সাইফুল মূলত বিএনপি করতো। তবে আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় থাকাকালীন সময় আওয়ামীলীগে যোগ দিয়েছিলেন। হোসেন সরদারও তখন আওয়ামীলীগে ছিলেন। কিন্তু ক্ষমতা চলে যাওয়ার পর শাজাহান মোহরীর সাথে বিএনপিতে যোগ দেন হোসেন সরদার। পরে এলাকার নেতৃত্ব দখলে নেওয়ার জন্য সাইফুলকে হত্যা করতে লোক ভাড়া করেন তিনি। কিন্তু সেই খবর জেনে যায় সাইফুল। পরবর্তীতে সাইফুল তার লোকজন নিয়ে হোসেনের বাড়িঘরে হামলা চালিয়ে তার লোকজনকে মারধর করে। হোসেনের লোকজন আবার সাইফুলের এক মামাকে তুলে নিয়ে মারধর করে। সেই ঘটনা মাসখানেক আগে মিমাংসাও হয়ে গেছে।
নিহত সাইফুলের স্ত্রী বলেন, আমার স্বামী খোয়াজপুর-টেকেরহাটের হাটবাজারের ইজারাদার। আমাদের আরো একটা মাস সময় ছিল। কিন্তু ওরা (হোসেন সরদার) বলতেছে যে ওরাই হাট খাবে। আমরা যাইও নাই হাটে খাজনা উঠাইতে। সরকারি লোক খাজনা উঠাইছে। এরপরও কি জন্য বুঝলাম না সব লোক এক হইয়া এইভাবে কোপাইয়া হত্যা করলো। এই হাটের ইজারা আমার স্বামী নিতে চায় নাই। জয়নাল মোল্লা চেয়ারম্যান ছিল তখন সে-ই সাইদ্দা আমার স্বামীকে দিছিল। সে (জয়নাল মোল্লা) ছিল নাসিম গ্রুপ।”
এই বিষয়ে মাদারীপুর সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মোকছেদুর রহমান জানান, এ ঘটনায় নিহত সাইফুলের মা সুফিয়া বেগম বাদি হয়ে থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। আসামিদের গ্রেপ্তার করতে আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে ওই এলাকায় পুলিশ ও সেনাবাহিনী মোতায়েন রয়েছে।
উল্লেখ্য, দীর্ঘদিন ধরে মাদারীপুর সদর উপজেলার খোয়াজপুরে কীর্তিনাশা নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে আসছিল ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবকলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সাইফুল সরদার। এ নিয়ে দ্বন্দ্ব হয় একই এলাকার শাজাহান খানের (শাজাহান মোহরী) সাথে। এরই জেরে খোয়াজপুর সরদারবাড়ি জামে মসজিদের সামনে একা পেয়ে সাইফুলের ওপর হামলা চালায় শাজাহানের লোকজন। এ খবর আশপাশে ছড়িয়ে পড়লে সাইফুলের দুই ভাই অলিল ও আতাবুরসহ প্রতিবেশীরা এগিয়ে আসেন। পরে মসজিদের ভেতরে প্রবেশ করে নিজেদের আত্মরক্ষার চেষ্টা করেন সাইফুল ও তার ভাই আতাবুর। এসময় মসজিদের ভিতরে ঢুকেই তাদের দুই ভাইকে কুপিয়ে হত্যা করে হামলাকারীরা। এসময় কুপিয়ে গুরুতর জখম করা হয় তাদের আরেক ভাই অলিল সরদার, পলাশ সরদার ও তাজেল হাওলাদারকে)। এ ঘটনায় চার নারীসহ অন্তত আরো ৫ জন আহত হয়। তাদেরকে উদ্ধার করে প্রথমে ২৫০ শয্যা জেলা সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে আশঙ্কাজনক অবস্থায় পলাশ সরদার, অলিল সরদার ও আজিজুল হাওলাদারের ছেলে তাজেল হাওলাদারকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়। সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় শনিবার দুপুরে পলাশের মৃত্যু হয়। এরপর নিহতদের বাড়িঘরে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছে হত্যাকারীরা।