
বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি: মিঠুন চন্দ্র রায়
মানুষ জীবনের পথে চলতে চলতে মাঝে মাঝে থমকে দাঁড়ায়। কখনো ব্যর্থতার বোঝা, কখনো ভরসার মানুষ হারানোর কষ্ট, কখনো আবার নিজের ভেতরের শূন্যতাই তাকে প্রশ্ন করে—আমি কি সত্যিই আমার জীবনটা আমার মতো করে বাঁচছি? ঠিক এমন এক প্রশ্ন থেকেই শুরু হয়েছিল অর্ণবের আত্ম-অন্বেষণের যাত্রা। আজ তিনি একজন সফল উদ্যোক্তা, মোটিভেশনাল বক্তা ও তরুণদের রোল মডেল। কিন্তু এ সাফল্যের গল্পের পেছনে লুকিয়ে আছে বহু অচেনা অন্ধকার, সংগ্রাম আর নিজেকে নতুন করে খুঁজে পাওয়ার এক দীর্ঘ পথচলা।

অর্ণবের জন্ম দিনাজপুরের একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে। বাবা সরকারি চাকরিজীবী, মা গৃহিণী। ছোটবেলা থেকে অর্ণব ছিলেন শান্ত, নিয়মিত পড়াশোনা করতেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে উঠতেই তার জীবন যেন ছন্দ হারাতে শুরু করে। পরিবার চেয়েছিল তিনি প্রকৌশলী হোন, কিন্তু অর্ণবের মন টানত লেখালেখি এবং সৃজনশীল কাজের দিকে। নিজের ইচ্ছা আর পরিবারের প্রত্যাশার মাঝে সময়ের বাঁকে বাঁকে তৈরি হচ্ছিল অস্বস্তি, দোটানা এবং অদৃশ্য চাপ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষে এসে সেই চাপ যেন অসহনীয় হয়ে ওঠে। তিনি পড়াশোনায় আগ্রহ হারান, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়, আর প্রতিটি সকালে ঘুম ভাঙলে মনে হতো তিনি যেন নিজের কোনো ছায়া হয়ে বেঁচে আছেন। হতাশা তাকে ধীরে ধীরে গিলে খাচ্ছিল। এক সময় এমনও মুহূর্ত এসেছিল—যখন তিনি নিজেকেই আর চিনতেন না।
তার সেই কঠিন সময়ের একটি সন্ধ্যা আজও তার মনে গেঁথে আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠের এক কোণে বসে হঠাৎই মনে হলো—জীবনের সব সিদ্ধান্ত কি অন্যরা নিয়ে দেবে? আমি কি নিজের জীবনটা একবারও নিজের মতো করে সাজাতে পারি না? ঠিক সেদিনই অর্ণব সিদ্ধান্ত নেন—তিনি নিজেকে খুঁজবেন, নিজের ইচ্ছাগুলোকে গুরুত্ব দেবেন, নিজের শক্তি-দুর্বলতা বুঝবেন। সেই সিদ্ধান্তই পরবর্তী জীবনের সবচেয়ে বড় বাঁকবদল।
পরদিনই তিনি নিজের রুটিন বদলানো শুরু করেন। প্রথম কাজ ছিল—নিজের ভেতরের অস্থিরতাকে ভাষা দেওয়া। তিনি লিখতে শুরু করেন, প্রতিদিনের অনুভূতি, ভয়, আশা—সব কিছু ডায়েরিতে তুলে রাখতেন। এর মাধ্যমে তিনি বুঝতে পারেন, তার সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল নিজের প্রতি আস্থা হারানো।
অর্ণব জানতেন শুধু লিখে থেমে থাকা যাবে না। তাই তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ক্লাব কার্যক্রমে যুক্ত হলেন। প্রথম দিকে সংকোচ, ভয়, কুঁকড়ে যাওয়া মন তাকে দ্বিধায় ফেলেছিল, কিন্তু ধীরে ধীরে তিনি উপলব্ধি করলেন—মানুষ নিজের খোলস থেকে বের হলেই প্রকৃত শক্তি খুঁজে পায়। ক্লাবের মিটিং, অনুষ্ঠান পরিচালনা, বক্তৃতা—সবই ধীরে ধীরে তাকে আত্মবিশ্বাসী করে তোলে।
নিজেকে নতুন করে খুঁজে পাওয়ার এই পথচলায় তিনি একটি বিষয় খুব গভীরভাবে বুঝতে পারেন:
জীবনে নিজের প্রতি দায়িত্ব নিতে হয়। কোনো ব্যর্থতা বা ভুল অন্যের নয়; আবার সাফল্যও কেবল ভাগ্যের ফল নয়। এই বোধ থেকেই তিনি নিজের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে উদ্যোক্তা হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। প্রথমে পরিবার এতে রাজি হয়নি। তাদের ভয় ছিল, এত অনিশ্চয়তার পথে যাওয়া যুক্তিসঙ্গত নয়। কিন্তু এবার অর্ণব থেমে থাকেননি। জীবনের সবচেয়ে কঠিন সিদ্ধান্তটি তিনি দৃঢ় মনেই নেন।
সামান্য মূলধন, বিশ্ববিদ্যালয়ের দু-একজন বন্ধু আর প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস নিয়ে শুরু হয় তার স্টার্টআপের যাত্রা—ডিজিটাল কন্টেন্ট ক্রিয়েশন এজেন্সি। শুরুতে ক্লায়েন্ট পেতে কষ্ট হতো, তহবিল সংকট ছিল প্রতিদিনের বাস্তবতা, অনেকেই তার পথচলাকে উপহাসও করত। কিন্তু তিনি জানতেন—পরিবর্তন একদিনে আসে না, আর নিজেকে নতুন করে গড়তে চাইলে দীর্ঘদিনের ধৈর্যই একমাত্র অস্ত্র।
তিন বছর পর সেই ছোট্ট উদ্যোগটি এখন সফল একটি প্রতিষ্ঠান। শুধু ব্যবসায়িক সফলতা নয়, অর্ণব তরুণদের আত্মবিশ্বাস বাড়ানো, মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা এবং পেশাগত দক্ষতা উন্নয়ন বিষয়ে নিয়মিত সেশন নেন। তার কথায়, “নিজেকে খুঁজে পাওয়ার সবচেয়ে বড় উপায় হলো নিজের ভেতরের সত্যটাকে স্বীকার করা। আমরা অনেক সময় নিজেদের ভয়, দুর্বলতা, ব্যর্থতা লুকাই। কিন্তু সেগুলোই আমাদের বেড়ে উঠার সবচেয়ে বড় শিক্ষক।”
অর্ণবের গল্পের সৌন্দর্য এখানেই—তিনি তার অন্ধকারকে অস্বীকার করেননি। বরং সেখান থেকেই আলো খুঁজে নিয়েছেন। আত্মঅন্বেষণের মাধ্যমে তিনি শুধু নিজের পথই খুঁজে পাননি, বরং হাজারো তরুণের অনুপ্রেরণার মানুষের পরিণত হয়েছেন।
আজ যখন তিনি পেছন ফিরে তাকান, সেই হতাশ, দ্বিধাগ্রস্ত তরুণটিকে যেন দূর থেকে দেখতে পান। কিন্তু একই সঙ্গে বুঝতে পারেন—যদি তখন তিনি সাহস করে নিজেদের প্রশ্ন করতে না পারতেন, তাহলে হয়তো এই অর্ণব কখনো জন্ম নিত না।
নিজেকে নতুন করে খুঁজে পাওয়া আসলে একদিনের গল্প নয়—এটি একটি চলমান যাত্রা। কখনো থেমে গিয়ে নিজের দিকে তাকানো, নিজের সত্যকে খুঁজে বের করা, আর ভুলকে শেখার সুযোগ হিসেবে নেওয়ার মধ্যেই লুকিয়ে থাকে সেই নতুন আলোর শুরু। অর্ণবের গল্প আমাদের শেখায়—জীবনে কোনো সিদ্ধান্তই দেরিতে হয় না, যদি তা আসে নিজের ভেতর থেকে।


















